কুষ্টিয়া শহরটা আদোতে ভীষণ আদুরে। খুব মায়াময়। এখানে ভোরের মিঠে আলোতে দেখা যায় হতচ্ছাড়া পাখিদের আর দলবেধে গপ্প করতে করতে হেঁটে চলা একঝাঁক প্রবীণদের। আপাতভাবে মনে হবে শরীরটাকে যুতসই করতে এদের এই কসরত। কিন্তু আমি খেয়াল করেছি এসবের আড়ালে রয়েছে তাদের গভীর বন্ধুত্ব। এই নগরে অতিবাহিত করা তাদের জীবনের খুচরো হাসি কান্নার স্মৃতিগুলো এই সময়ে তারা দারুণভাবে হাতরায়। আমি তাদের পিছুপিছু হাাঁটি। কল্পনায় ছবি আঁকি। শহরের অলিগলি, রেইনউইক, ডিসিকোর্ট জুড়ে তখন তাদের রাজত্ব। এরপর ঘুমে ডুলুডুলু মেয়ে মায়ের সাথে ক্রিংক্রিং রিক্সায় চেপে ইশকুলে যাচ্ছে। কোর্ট ষ্টেশন মৌ মৌ করছে নতুন পত্রিকার গন্ধে। ছয় রাস্তার মোড়ে কিংবা এনএস রোডের কিছু জায়গাতে তখন উপচে পড়া ভীড়। কাহিনী কি? তেজে ভাজা লুচি, ডালের লোভে সেই শরীর সচেতন কাকু, দাদুরা হল্লা করছে৷ আশপাশ থেকে শোনা যাচ্ছে খাঁটি কুষ্টিয়ার বুলি, "ডাইল আরিকটু বাড়া দিতে কি হয় তুমার!" "এম্মা করলি তো তুমার কাছে আসবো নানে!" এইসব। কান পেতে শুনি সেই ভাষা যে ভাষায় আমার পূর্বপুরুষেরা সারাটা জীবন কাটিয়েছেন। কেউ কেউ মিউনিসিপালিটি বাজার থেকে ব্যাগ ভরে বাজার করে ফিরছেন৷ ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে লাউয়ের ডগা বা পুঁইশাক।
এরপর গাড়ি, ঘোড়া, হট্টগোলে ব্যস্ততা বাড়ে নগরীর। হাসপাতাল মোড় থেকে ষ্টেশন অব্দি জ্যাম। রিক্সাওয়ালার সাথে অটোওয়ালার গালাগালি, তিক্ত বিরক্ত যাত্রীরা। কিন্তু এইসবও আমার কাছে ভীষণ আপন লাগে কেন জানি! জ্যামটাও কিউট। কারন এ তো ঢাকার জ্যাম না যে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষায় যাবে৷ অটোওয়ালাকে পাঁচ টাকা দিয়েই হাঁটা শুরু করি। শহরতো ভীষণ ছোট্ট। খানিকটা হেঁটেই চলে আসা যায়৷ এর মধ্যেই পোঁ পোঁ শব্দে ট্রেন চলে যায় শহরের বুক দিয়ে। ট্রেনে চেপে যারা যায় তারাও উৎসুক চোখে চোখ বুলায়। মানুষ দেখে, গাড়ি দেখে, বাড়ী দেখে। ছেলেবেলায় ছয় রাস্তায় কয়েকটা ঠেলাগাড়ি দেখতাম শুধু। এখন সেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঝলমলে শপিং কমপ্লেক্স। কিছু কেনার ছুতোয় শরীরটা জিরিয়ে নেই৷ ঘড়ির কাঁটা বারোটায় ঠেকেছে। মনে পড়লো এই সময়েই তো শিশির বেকারির গরম গরম ডিম প্যাটিস পাওয়া যাবে! শরীরজুড়ে খিদেরা জানান দিলো। সেই জিলা স্কুলে পড়ার সময় মাসে দু'য়েকবার এই অমৃতের দর্শন পাওয়া যেত। সেই থেকেই তার সাথে নির্লজ্জের মতো প্রেম। রিক্সায় চেপে ডিপ প্যাটিস খেতে খেতে রেইনউইকে আসা। আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কড়ই গাছেরা। কি বিশাল!
0 মন্তব্যসমূহ